সৌদি আরবের শীর্ষ স্কলার বিটকয়েনকে হালাল বলেছেন - তার যুক্তিগুলো কি কি ?

 বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ক্রিপটোকারেন্সি হালাল নাকি হারাম এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । দুনিয়ার মুসলিম আলেমদের একাংশ মনে করে ডিজিটাল অর্থ ব্যবস্থার সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই আবার আরেক অংশ মনে করে এটা জুয়ার শামিল । 


পৃথিবীর বহু দেশেই ক্রিপটোকারেন্সি নিষিদ্ধ যার ভেতর সম্প্রতি নাম লিখিয়েছে ভারত এবং সেদেশে ক্রিপটো এক্সচেঞ্জের ভেতর জনপ্রিয় বাইন্যান্স নিষিদ্ধ করেছে,  ক্রিপটো বুথ নিষিদ্ধ করেছে এবং চায়নাতে ক্রিপটো নিষিদ্ধ । তার পরিবর্তে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা প্রবর্তন করতে যাচ্ছে দেশটি । মুদ্রার উলটো দিকে এল সালভাদর নামক রাষ্ট্র বিটকয়েনকে রাষ্ট্রীয় মুদ্রা ঘোষণা করে এবং সর্বস্তরে এই মুদ্রা ব্যবহার শুরু করেছে । 

গত বছরের শেষদিকে সৌদি আরবের বিখ্যাত সালাফি গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল্লাহ বিন সুলায়মান আল মানিয়া বিটকয়েনকে হালাল বলেন এবং কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেন । আপনি যদি এই বিখ্যাত মুফতিকে না চিনে থাকেন তাহলে জানিয়ে রাখি, প্রতিবছর হজের মৌসুমে তিনিই সবচেয়ে বেশিবার হজের খুতবা পাঠ করেন । যিনি হজের খুতবা পাঠ করেন তার নিকট থেকে কোন বিবৃতি এলে অবশ্যই সেটা গুরুত্ব পাবে ।   

তিনি বিটিসিকে হালাল বলে যেসব মতবাদ প্রদান করেছেন সেগুলি জানা যাক - 


 প্রথমত, বিটকয়েন নিছক কোন ভার্চুয়াল সত্তা নয় বরং এর বাস্তব উপযোগিতা রয়েছে । তিনি একে স্বর্ণ, রৌপ্যের সাথে তুলনা করেছেন এবং মানুষ একে কারেন্সি হিসাবে যেভাবে ব্যবহার করে বিটকয়েন ব্যবহারেও একই দিক রয়েছে এবং স্বর্ণ, রৌপ্যের মতই একে খনন (মাইনিং), লেনদেন ও সংরক্ষণ করা যায় । 

তিনি বলেছেন এটা ফিয়াট (টাকা, ডলার, পাউন্ড) কারেন্সির থেকেও বেশি বিশ্বস্ত ও স্থিতিশীল যা আলগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বিধায় এর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফিতি রোধ করা যায় । কারণ ফিয়াট কারেন্সির মত এটা গণহারে ছাপানো যাচ্ছে না বরং এর সাপ্লাই নির্দিষ্ট । 

দ্বিতীয়ত, তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, এটা জুয়ার মত কোন ক্ষেত্র নয় বরং বিনিয়োগ ও সঞ্চয় করা যায় । তিনি জানিয়েছেন এটা প্রচলিত স্টক বা বন্ডের মত নয় যা সরকারের কার্যক্ষমতার উপর নির্ভর করে । এটা বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যার দ্বারা মানুষের পছন্দ ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটে । 

তিনি বলেছেন যে, ফিয়াট কারেন্সির মত এর দরপতন হয়ে মুল্যমান হারিয়ে যায় না বরং অর্থনীতির গতানুগতিক নীতি অনুসরণ করে । তিনি বলেছেন এটা শুন্য সমষ্টির কোন খেলা নয় যেখানে এক পক্ষ লাভ করে এবং আরেকপক্ষ ক্ষতির মুখে পড়ে । বরং এতে রয়েছে ইতিবাচক মাধ্যম যার দ্বারা এর অগ্রগতি ও বিকাশের দ্বারা সব পক্ষ লাভের মুখ দেখে প্রতিনিয়ত । 

তৃতীয়ত, বিটকয়েন সন্ত্রাসের কোন হাতিয়ার নয় । এটা ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার হাতিয়ার । তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বিটকয়েন প্রচলিত অর্থের মত নয়, যা সনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে । বরং ফিয়াট কারেন্সি দ্বারা এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর আঘাত করতে পারে এবং তাকে অন্যান্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । তিনি বলেছেন, এর বেনামী বৈশিষ্ট্যের কারণে যে কেউ এটা ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ণ গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারে । 

তিনি জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদ ও মুদ্রাপাচারের কোন মাধ্যম নয় বরং এটা মুসলিমেরা সহজেই এর দ্বারা নিপীড়িতের কাছে যাকাত ও দাতব্য সাহায্য পাঠাতে পারে যা ফিয়াট কারেন্সির মাধ্যমে নজরদারির প্রভাবে করা যায় না । তিনি বলেছেন, বিটকয়েন দরিদ্র ও নিপীড়িতদের সীমাহীন অর্থব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার দেয়ার মাধ্যমে সুন্দরভাবে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে । 

তিনি বলেছেন, মুসলিমদের বিটকয়েন ব্যবহারকে নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করতে তিনি চান না যতক্ষণ তারা ভালো উদ্দেশ্য ও নৈতিক নীতি অনুসরণ করে । তিনি বিশ্বাস করেন, জালিমদের আগ্রাসনের যুগে বিটকয়েন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা আশীর্বাদ যিনি মানবজাতির জন্য সব সহজ করে দিয়েছেন । তিনি আশা করেন, মুসলিমরা বিটকয়েনকে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে পারে ও মানবতার উন্নয়নে অবদান রাখবে । 

যদিও ২০২১ সালের একটা টিভি সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন বিটকয়েন হারাম । যেহেতু তিনি সৌদি আরবের ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত তাই প্রশ্ন আসে, তিনি কি কারো চাপে পড়ে একে হালাল সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছেন ? নাকি নিজের ব্যবসাকে আরও বাড়িয়ে নিতেই এরকম ফতোয়া দিয়েছেন ? 





অন্যদিকে রাশিয়ান টিভি নেটওয়ার্ক (আরটি) এর সূত্র অনুযায়ী,  রুশ উলামা কাউন্সিল গ্রান্ড মুফতি ইলদার আলাউদ্দিনভ জানিয়েছেন, " 

‘ইন্টারনেট প্রযুক্তির যেসব খাত জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, সেসব খাতকে কাউন্সিল সবসময়েই সমর্থন করে। এই নীতির আলোকে কাউন্সিল মনে করে, মুসলিমরা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার ও বিনিয়োগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।’

তারা তুরস্ক, জর্ডান, জার্মানি, মিশরের উলামা কাউন্সিলের সাথে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে,  

"মুসলিমরা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার ও বিনিয়োগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।’


এছাড়াও সৌদি আরবের আরেকজন আশিম আল হাকিম বলেছেন, বিটকয়েন হারাম এবং এজন্য কয়েকটা যুক্তি দেখিয়েছেন । তিনি জেদ্দা ভিত্তিক ইমাম এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব । তিনি বলেছেন, 

প্রথমত, এটা বেনামী এবং একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এবং আমরা জানি না এটা কোথায় ব্যবহার করা হয় । এর অর্থ হল এটা দ্বারা অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেমন মুদ্রা পাচার ও ড্রাগ মানি ইত্যাদি । 

দ্বিতীয়ত, এতে অনুমান নির্ভর এলগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে । একে কেউ মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করে না এবং এটা থেকে মুনাফা অর্জনের জন্য লোকেরা একে ব্যবহার করে । অন্যদিকে এর মাধ্যমে অর্থ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে যার কারণে একটা জুয়া যা ইসলামে নিষিদ্ধ । 

তৃতীয়ত, আল হাকিমি বলেছেন যে, এর ভেতর অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে, যেমন নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব । মুদ্রার নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ, এটা বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে । অর্থ উপার্জনের ইসলামি উপায়ের ভেতর বিটকয়েনের নীতিগুলি প্রশ্নবিদ্ধ । 

প্রিয় পাঠক, আপনি কি ভাবছেন ? বিটকয়েনকে সালাফি স্কলারের মতামত অনুযায়ী গ্রহণ করতে চান নাকি জেদ্দার আশিম আল হাকিমীর ফতোয়া মোতাবেক বর্জন করার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবেন ? তাছাড়া আমরা জানি, সৌদি আরব কয়েক বছর ধরেই ইসলামিক অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসছে । সুতরাং, আপনার বুদ্ধিতে কি ভাবছেন ? কি করবেন আপনি ? নাকি রুশ কাউন্সিলকে মেনে নিবেন যারা বলছে আপনি এর দ্বারা উপকৃত হতে পারলে ইসলামে কোন বাঁধা নাই । যেহেতু এটা নিয়ে মিশ্র মতামত রয়েছে তাই আপনার সিদ্ধান্তই শেষ কথা । আমি আপনাকে কোন নির্দেশনা প্রদান করবো না । ধন্যবাদ 


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.